মানুষ মাত্রই স্বপ্ন দেখে। স্বপ্ন দেখে- নানা রঙে, নানা মাত্রায়। স্বপ্ন দেখার এই শক্তি একমাত্র মানুষের মাঝেই রয়েছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে এখানেই মানুষের পার্থক্য। প্রকৃতির শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হলো মানুষ, যে নিজের মতো করে ভাবতে পারে, নিজের পছন্দমতো স্বপ্ন দেখতে পারে এবং তা বাস্তবায়নে পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে পারে। তাই আগামী দিনগুলোতে যে পরিবর্তন আসবে, তার সঙ্গে মিলিয়ে নিজেকে প্রস্তুত করার জন্য এখন থেকেই আমাদের পথ পরিক্রমা সাজাতে হবে। সত্যিকার অর্থে আমাদের জন্য কোন পেশা অপেক্ষা করছে, তা আমরা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারব না। কারণ, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের (4IR-Fourth Industrial Revolution) সম্ভাবনা এবং চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। প্রযুক্তির কল্যাণে এবং গ্রিন পরিবেশ ও টেকসই অর্থনীতির প্রয়োজনে ভবিষ্যতে অনেক নতুন পেশা বা কর্মক্ষেত্র তৈরি হতে পারে। এগুলো প্রয়োগের ক্ষেত্র ও সুবিধা সম্পর্কে জানা এবং নিজেদের ভবিষ্যতের ক্যারিয়ারের জন্য প্রস্তুত করা আমাদের জন্য খুবই জরুরি। একটি সফল কর্মজীবনের পথ তৈরি করার জন্য এসব পরিবর্তন বিবেচনায় রেখে আমাদের যথাযথ পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি নিতে হবে।
আমরা প্রায় সবাই নাসার কথা শুনেছি। সৌরজগতের বিবর্তনের ইতিহাস নিয়ে মানুষের জল্পনা কল্পনার সবচেয়ে শক্তিশালী ও কার্যকর ঘাঁটি হচ্ছে নাসা (NASA-National Aeronautics and Space Administration) | এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি স্বাধীন সংস্থা, যা বিমানচালনাবিদ্যা ও সৌরজগৎ সম্পর্কিত গবেষণা করে থাকে। আজ নাসার একজন বিজ্ঞানীর গল্প শুনব।
বাংলাদেশের এক প্রত্যন্ত গ্রামে বেড়ে ওঠে শাহনাজ। ছোটোবেলায় খেলাধুলায় মনোযোগী ছিলেন। আঁকাআঁকি করতেও বেশ পছন্দ করতেন। কিন্তু রাতের আকাশ দেখা ছিল তার প্রিয় কাজের একটি। মাধ্যমিকে পড়ার সময় সায়েন্স ফিকশন ও পদার্থবিদ্যায় তৈরি হয় তার প্রবল আগ্রহ। উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে তাই ভর্তি হন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি (সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি) সংক্রান্ত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন শাহনাজ এবং তার সঙ্গে পড়ুয়া আরও অনেকে। পরপর তিনবার অংশগ্রহণ করেও তাদের টিমের পুরস্কার পাওয়া আর হয়ে ওঠে না। কিন্তু তাতে নিজের ওপর আস্থা হারাননি শাহনাজ। হতাশাকেও ঠাঁই দেননি মনের কোণে; বরং একেকটি হার যেন তার জন্য একেকটি অনুপ্রেরণা। প্রতিটি প্রতিযোগিতার পর সবাই মিলে নিজেদের ঘাটতি আর কী কী ভুল ছিল, কীভাবে ভুলগুলো শুধরানো যায়, প্রজেক্টের কী কী চ্যালেঞ্জ ছিল ইত্যাদি খুঁজে বের করেন এবং এরপর নতুনভাবে প্রজেক্ট তৈরির পরিকল্পনা করেন।
মহাজাগতিক রেডিয়েশন মহাকাশে আলোর গতিতে চলা উচ্চশক্তির প্রোটন এবং পারমাণবিক নিউক্লিয়াস থেকে সৃষ্ট বিকিরণে প্রভাবে সৃষ্ট একধরনের পরিস্থিতির কবল থেকে রক্ষা করার জন্য তাঁরা মহাকাশচারীদের জন্য তৈরি করেন এক বিশেষ পোশাক। তাঁদের এই প্রজেক্ট পরবর্তী সময়ে বিশ্বের অনেক দেশকে হারিয়ে প্রতিযোগিতায় পুরস্কার জিতে নেয়। এরপর তিনি অ্যাস্ট্রোফিজিকসে মহাশূন্য, শক্তির বিকিরণ, কৃষ্ণগহ্বর ইত্যাদি নিয়ে গবেষণা পড়াশোনার জন্য বৃত্তি (স্কলারশিপ) পেয়ে বিদেশের মাটিতে শুরু করেন তার গবেষণা জীবন। গবেষণাকালেই তিনি টেক্সাসের হিউস্টনে অবস্থিত নাসার জনসন স্পেস সেন্টারে শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ শুরু করেন। দক্ষতা ও কাজের প্রতি একাগ্রতা তাকে নাসায় কাজ করার অনন্য সুযোগ এনে দেয়। বর্তমানে শাহনাজ নাসায় একজন বিজ্ঞানী হিসেবে কাজ করছেন, যা ছিল তাঁর একসময়কার স্বপ্ন! ছোটোবেলা থেকেই সায়েন্স ফিকশন এবং বিজ্ঞান চর্চায় অনুরক্ত শাহনাজের কল্পনার জগৎ থেকে বাস্তবের পৃথিবীকে জানার যে যাত্রা, তা ছিল অসাধারণ। শাহনাজ এখন দীক্ষিত হয়েছেন নাসায় প্রচলিত 'এখানে ব্যর্থ হওয়ার সুযোগ নেই' এই মন্ত্রে।
সাধারণভাবে বলা যায়, জীবনের সুনির্দিষ্ট কর্মময় অংশই হলো ক্যারিয়ার। সারা জীবন একজন মানুষ তার পেশা-সংক্রান্ত যেসব কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন, তা-ই হলো তার ক্যারিয়ার। কারিয়ার স্থির কিছু নয়, বরং পরিবর্তনশীল ও বিকাশমান। সবাই কামনা করেন, তার ক্যারিয়ারের এই পরিবর্তন বা বিকাশ যেন নিজের সাজানো লক্ষ্য অনুযায়ী হয়। ক্যারিয়ার সুন্দরভাবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে সবাইকে বিশেষ কিছু দিক লক্ষ রাখতে হয়:
ক) নিজের দক্ষতা এবং আগ্রহ ভালোভাবে জেনে নেওয়া: যেকোনো ব্যক্তির ক্যারিয়ার গঠনের ক্ষেত্রে নিজেকে জানা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণেই আমরা ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণিতে 'কাজের মাঝে আনন্দ', 'কী আছে আমার মাঝে', 'আমার জীবন আমার লক্ষ্য' ইত্যাদি অভিজ্ঞতায় বিভিন্ন মজার কাজের (অ্যাক্টিভিটি) মধ্য দিয়ে নিজেকে জানার প্রচেষ্টা চালিয়েছি। নিজের ভালো লাগা, মন্দ লাগা, কাজের প্রতি আগ্রহ, মনোযোগ, পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধ ইত্যাদির পাশাপাশি নিজের দক্ষতা আছে কি না, সে বিষয়টিও ক্যারিয়ারের অগ্রযাত্রায় ভূমিকা রাখে। আমরা সাধারণত যেসব কাজ করতে ভালোবাসি, তা যদি জীবনের অধিকাংশ সময় ধরে করি, তাহলে সেই কাজ বা ক্যারিয়ার নিশ্চয়ই আনন্দময় হয়ে উঠবে।
খ) বিভিন্ন ধরনের পেশা সম্পর্কে ভালোভাবে জানা: নিজের পছন্দ বা দক্ষতা অনুযায়ী আমরা যা করতে চাই, তা খুঁজে বের করতে হবে। এ কাজটি করার জন্য আমাদের বিভিন্ন ধরনের পেশা, বৃত্তি, কাজ বা চাকরি সম্পর্কে অবশ্যই জানতে হবে। কোন ধরনের পেশার কাজ কী, সেগুলোতে কী ধরনের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা প্রয়োজন হয়, তা জানার চেষ্টা করতে হবে। এগুলো জানা থাকলে নিজের কাজের ক্ষেত্র নির্বাচন করা বা খুঁজে বের করা সহজ হবে।
গ) লক্ষ্য নির্ধারণ ও পরিকল্পনা প্রণয়ন: ক্যারিয়ারের গতি বা বিকাশ চলমান রাখার জন্য এবং সফল ক্যারিয়ার গঠনের ক্ষেত্রে লক্ষ্য নির্ধারণ ও পরিকল্পনা প্রণয়ন করা অপরিহার্য। লক্ষ্য বা গন্তব্য স্থির করা না থাকলে অনেক সময় দেখা যায়, নিজের যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও সফল ক্যারিয়ার গঠন করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। লক্ষ্য নির্বাচন করা হলে সেই অনুযায়ী কোন পর্যায়ে কী কী কাজ করতে হবে, কী ধরনের দক্ষতা অর্জন করতে হবে, কোন ধরনের প্রশিক্ষণ কখন করতে হবে ইত্যাদি বিষয়ক পরিকল্পনা করা সম্ভব হয়। এজন্যই ধাপে ধাপে পরিকল্পনা করার কৌশল আমরা পূর্বের শ্রেণিতে অনুশীলন করেছি।
ঘ) সংশ্লিষ্ট চাকরি বা কাজের ক্ষেত্র অনুসন্ধান করা: বিভিন্ন গণমাধ্যম, পত্রপত্রিকায়, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের চাকরির খোঁজ পাওয়া যায়। ক্যারিয়ার গঠনে এসব খোঁজ রাখা বা অনুসন্ধান করা খুব জরুরি। তবে এক্ষেত্রে অনেক যাচাই-বাছাই করার প্রয়োজন। নিজের জ্ঞান, দক্ষতা, মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কি না, বা এটি করার আগ্রহ আছে কি না এবং পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা আছে কি না- এই বিষয়গুলো ধৈর্য সহকারে খুঁজে দেখতে হবে।
ঙ) সময়ের চাহিদা অনুযায়ী কাজের ক্ষেত্র বা চাকরি পরিবর্তন: ক্যারিয়ারের এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক। আমরা জানি, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কাজের ধরন ও চাকরির ক্ষেত্র বদলায়। সুতরাং সময়ের চাহিদার সঙ্গে মিলিয়ে নিজেকে হালনাগাদ রাখা এবং প্রয়োজনীয় যোগ্যতা অর্জন করা খুব জরুরি। এ কারণে ক্যারিয়ারকে আরও সুগঠিত ও সাফল্যময় করার জন্য সময় ও সুযোগ অনুযায়ী কাজের ক্ষেত্র পরিবর্তন করতে হয়। নিজের নতুন অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে আরও সুবিধাজনক চাকরি খুঁজে বের করা আমাদের ক্যারিয়ারের অগ্রযাত্রারই একটি অংশ।
মনোবিজ্ঞানী ডোনাল্ড সুপার আমাদের ক্যারিয়ার জীবনের বিভিন্ন পর্যায় নিয়ে একটি মডেল দাঁড় করিয়েছেন, যা life rainbow নামে পরিচিত। এখানে সময়ের সঙ্গে মানুষের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার যে পরিবর্তন ও স্থিতি দেখা যায়, তা দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে।
ক্যারিয়ার নির্বাচনের জন্য বিদ্যমান পেশা, কাজের ক্ষেত্র এবং ভবিষ্যতে এসব পেশা ও কাজের ক্ষেত্রে কী ধরনের পরিবর্তন ও রূপান্তর আসতে পারে সে সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা থাকা দরকার। বিভিন্ন খাতের পেশা সম্পর্কে আমরা ইতিপূর্বে কিছু তথ্য জেনেছি; এখন আমরা আগামীর সম্ভাব্য পেশা সম্পর্কে আরও জানার চেষ্টা করব। আমরা ফার্নিচার শিল্পে একসময় কাঠ রানদা করতে দেখেছি। কাঠমিস্ত্রি অনেক কষ্ট করে হাতে রানদা টেনে কাঠ পলিশ করতেন। আর এখন এসেছে কাঠ ফিনিশিং মেশিন বা উড প্ল্যানার মেশিন। যার ফলে অল্প সময়ে মেশিনে অনেক বেশি কাঠ পলিশ করা যাচ্ছে। সময়ের সঙ্গে এরকম হাজারো প্রযুক্তির আগমন সব পেশাতেই নিয়ে এসেছে যুগান্তকারী রূপান্তর।
মজার বিষয় হলো, কোন পেশাগুলো পূর্বে ছিল, এখনো আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে; আবার কোনগুলো বিলুপ্ত হতে পারে, তা নিয়ে আমাদের দেশে একটি গবেষণা হয়েছে, সেখানে পেশার অতীত, বর্তমান এবং রূপবদল নিয়ে তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরা হয়েছে। গার্মেন্টস ও টেক্সটাইল, ফার্নিচার, এগ্রো প্রসেসিং, লেদার এবং ট্যুরিজম ও হসপিটালিটি- এই পাঁচটি সেক্টরে গবেষণাটি পরিচালিত হয়। সেখানে দেখানো হয়েছে। গার্মেন্টস এবং ফার্নিচার সেক্টরে শতকরা ৬০ ভাগ পেশা (বর্তমানে চলমান) ঝুঁকির মধ্যে আছে। পাশাপাশি এগ্রো ৪০ ভাগ, লেদার ৩৫ ভাগ এবং ট্যুরিজম ও হসপিটালিটির ক্ষেত্রে ২০ ভাগ পেশা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এই পেশাগুলোর কিছু আংশিক বদলে যাবে, কিছু রূপ বদল হবে, আবার কিছু একবারে বন্ধ হয়ে যাবে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর রিপোর্টের দিকে তাকালে দেখতে পাই, জিডিপিতে শিল্প ও পরিষেবার সম্মিলিত অবদান ৮৮ শতাংশ, যেখানে আনুষ্ঠানিক এবং অনানুষ্ঠানিক খাতের অবদান রয়েছে। জীবন ও জীবিকার দিক থেকে অনানুষ্ঠানিক শ্রমবাজার বলতে ব্যক্তি উদ্যোগে কোনো কাজ, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বা চাকরির এক অর্থনৈতিক খাতকে বোঝায়, যা সরকার বা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত বা সুরক্ষিত নয়। যেমন: নিজের জমি, দোকান বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কাজ, গৃহস্থালি কাজ, হকারি, দিনমজুরি প্রভৃতি।
অন্যদিকে আনুষ্ঠানিক শ্রমবাজার হলো অনেকটা নিয়ন্ত্রিত ও সুরক্ষিত, যেখানে সময় ও শ্রম পরিমাপের ভিত্তিতে আর্থিক ও অন্যান্য সুবিধা নিয়ন্ত্রিত হয়। আনুষ্ঠানিক শ্রমবাজারে কাজের নিরাপত্তা, কর্মপরিবেশ, মজুরি, উৎপাদনশীলতা ইত্যাদি অনেকাংশে নির্ধারিত থাকে। আনুষ্ঠানিক শ্রমবাজারে সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ যেমন: উন্নয়ন পরিকল্পনা, কর্মপরিকল্পনা, ভর্তুকি ইত্যাদি থাকে। আবার অনানুষ্ঠানিক শ্রমবাজারে সরাসরি এ ধরনের উদ্যোগ না থাকলেও বিশেষ প্রয়োজনে নেওয়া হয়ে থাকে। যেমন: করোনার সময়ে আমরা দেখেছি, সরকার কৃষকদের বিশেষ ভর্তুকি দিয়েছে।